আমি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার পক্ষপাতী না। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কারো ধর্ম নিয়ে অপমানকর কথা বলা ঠিক নয়। কারো বক্তব্যে দ্বীমত থাকলে উন্মুক্ত আলোচনা ও আন্দোলনের মাধ্যমে তা সমাধান করা যায়। কিন্তু দ্বিমতের জন্য কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবহার করতে হবে, রাষ্ট্রকে সেটার উপর নতুন আইন বানাতে হবে, এটা অন্যায়। লতিফ সিদ্দিকীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের ধর্মগুরুরা বা আলেম-ওলামাগণ একটি উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করতে পারতেন, উনাকে অবশ্যই সেখানে আলোচনায় অংশ নিতে বাধ্য থাকতে হত যেহেতু তিনি একটি দায়িত্বশীল পদে আছেন, তাই তার আচরণ একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মূল্যায়ণ পাবার যোগ্য। কিন্তু আইনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হল সরাসরি গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পথ রুদ্ধ করা। তাছাড়া তিনি তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়ে গিয়েছিলেন। দল এবং পদ থেকে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, দেশ ছাড়া ছিলেন বেশ কিছুদিন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সারা জীবনের অর্জন- সম্মান হারিয়েছেন। এর চেয়ে আর বেশি শাস্তি কী হতে পারে? কিন্তু না, তাকে হয়তো আরো শাস্তি পেতে হবে, যা অপ্রয়োজনীয় এবং আরেকটি অন্যায়। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আশংকাজনক হারে কমছে। কথার বিচার কথা দিয়ে নয়, জেল কিংবা ফাঁসি। ধমকের বিচার জবাই কিংবা হিংস্র আক্রমণ। অপমানের বিচার সরাসরি কল্লা কর্তন। এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এখন ধর্মের নামে কল্লা কর্তন এবং ফাঁসির দাবিকারী লোকের সংখ্যাই বাড়ছে। শিক্ষিত তরুণ থেকে মাদ্রাসার ছাত্র পর্যন্ত আলোচনা করতে বা শুনতে চায় তো না-ই, পারলে তখনই দ্বিমত পোষণকারীকে খুন করে। ব্লাসফেমি আইন সম্পর্কে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের তেমন ধারণা নেই। আমারও নেই বিস্তারিত। তবে সাধারণত ধর্ম অবমাননার জন্য যে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয় সেটাই ব্লাসফেমি আইনের মধ্যে পড়ে বলে জানি। আমাদের দেশে এমন আইন এখনো চালু হয়নি, তারপরও ধর্ম অবমাননার জন্য মানুষকে জেলে নেয়া শুরু হয়েছে। ব্লাসফেমি আইন থাকলে না জানি কী হত! সম্ভবত অবস্থা পাকিস্তানিদের চেয়েও ভয়াবহ হত। কারণ এ আইনটির সুফল নেই কোন। এটার অপব্যবহার করার সুযোগ থাকে সবচেয়ে বেশি এবং সেটাই আসলে হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে যাদের আসামী করা হয় তাদের কাজের প্রমাণ বা সাক্ষীর কোন দরকার হয় না, বাদীর অভিযোগই যথেষ্ট। আসলে ধর্ম এমন একটি বিষয় যা নিয়ে রাজনীতি করা একদম খাটে না, এটা ভালবাসা এবং আবেগের ব্যাপার। এখানে আইন খাটে না, যেকোন ধর্মীয় ইস্যু তাই আমাদের সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নিয়ে গেলে রাষ্ট্রেী বৈচিত্র্যমুখী চরিত্র নষ্ট হয়। রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর হয়ে পড়ে। কিন্তু তা কোন মানব কল্যানমুখী সমাজ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। হয়ে পড়ে সৃষ্টিহীন, বন্ধ্যা এবং অনাচারযুক্ত সমাজের প্রতিরূপ। ধর্মীয় অনুভূতি যে সমাজের যত তীব্র সে সমাজ তত বেশী ক্ষয়িষ্ণু। কারণ সৃষ্টিকর্তার প্রতি যার বিশ্বাস যত গভীর সে তত বেশী বিনয়ী, ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে সে কখনো অসহিষ্ণু হয় না। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিতে আমাদের মত একটুতেই আঘাত লাগে না। অতএব, আপনার ধর্মীয় অনুভূতিকে সংহত রাখুন। সব মানুষকে ভালবাসুন। তাহলে দেখবেন এত ক্ষোভ আর ঘৃণা কারো প্রতি হবে না সহজে, আর খুব সহজে আপনার ধর্মের হাত পা ভাঙবে না।
আপনি কোন বাংলাদেশ চান – তিন
ফেসবুকের মাধ্যমে মন্তব্য করুন: