সবাইকে না, দুনিয়ার সকল সিঙ্গেল ও ডিসট্যান্ট রিলেশনশিপে থাকা লোকজনকে ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। কারণ এরাই একমাত্র ভালবাসা দিবসের মর্ম বোঝে। যারা একসাথে সময় কাটাচ্ছেন বা প্রেম করতেছেন কিংবা বিবাহিত, এদের শুভেচ্ছা জানিয়ে লাভ নাই। কেননা, এরা নিজেদের দুনিয়ায় এত ব্যস্ত যে অন্যদের শুভেচ্ছার তাদের দরকার নেই। আই মিন, ধরুন, যারা ইতিমধ্যেই বিবাহিত, তাদের দিনে একবার হলেও মনে হয়, ‘কেন যে বিয়ে করলাম!’ আর যারা প্রেম করতেছে, এরা সারাক্ষণ ভাবে, বিয়েই সব সমস্যার সমাধান, তাই বিয়ের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতেই তারা এত ব্যস্ত যে ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে তারা খুব ভাবিত না।
এই কারণেই সম্ভবত আমাদের সমাজে কোন অবিবাহিত বা সিঙ্গেল নারী/পুরুষকে তার প্রতি বিবাহিত নারী/পুরুষ বন্ধু,পরিচিত,আত্মীয় যদি সত্যিই স্নেহশীল হয়, কোনদিনও বলেনা না, ‘বিয়ে কর’। বরং বলে, ‘ভাই তুমিই ভাল আছো, বিয়ে কোরোনা, যতদিন পারো সিঙ্গেল থাকো’।
আর যেসব পরিবারে বাবা মা আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবরা মরিয়া হয়ে চায় ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ গতিতে বা প্রক্রিয়ায় বিয়ে হোক, এদের ইচ্ছে বিশ্লেষণ করলে আসলে কি পাওয়া যায়? এদের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ কোন না কোন সময়, তাই এদের শুভাকাঙ্ক্ষায় বিশ্বাস করে লাভ নেই, অযথাই লোকদেখানেপনা, এরা অত্যধিক কম্পিটিটিভ মনোভাবের কিংবা নিতান্ত এরা যে সাফারিংস এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সে সাফারিংস বিয়ের পরে ঐ সিঙ্গেলও এক্সপেরিয়েন্স করুক, এটাই তাদের প্রকৃত অবচেতন মনের চাওয়া।
আচ্ছা এইসব যে একজন সিঙ্গেল/অবিবাহিত মানুষের সাথে ঘটে, এর পেছনে আসলে কারণ কি? আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি? ভেবে কুলিয়ে ওঠা শক্ত। একেতো ভালবাসা Biologically খুবই Mysterious একটা Function। এটাকে আমাদের সমাজে রোমান্টিক বা দর্শনের মোড়কে দেখা হয়। কিন্তু বিষয়টা আসলে সাইন্টিফিক যার রহস্যময়তা এখনও বেশ অনাবিষ্কৃত। একজন মানুষের জীবনে সত্যিকারের ভালবাসা আসা বেশ কঠিন, Rare ব্যাপার। কিছুটা লটারি পাবার মত। জীবনের যেকোনো সময় তা আসতে পারে। কিন্তু কখন আসবে সে তা জানেনা, আবার একাধিকারও আসতে পারে। আর আমাদের সমাজে এই প্রক্রিয়াটাকে আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে ফলে এটা স্বাভাবিকভাবে তৈরি হওয়া একরকম অসম্ভব। নানারকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে অবদমন, পীড়ন, নির্যাতন ইত্যাদি চালু থাকা অবস্থায় মানসম্পন্ন ভালবাসা তৈরি হতে পারে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করিনা। তো এত নেতিবাচক উপাদান সমাজে চালু থাকার পরও যদি কেউ কেউ সত্যিকারের ভালবাসা Experience করে সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বেশিরভাগ ভালবাসার গল্পই আরোপিত কিংবা সাজানো মিথ্যা। যদিও কেউ কেউ চেষ্টা করে ভালবাসতে কিংবা ভালবাসা তৈরি করতে। যাইহোক চেষ্টা করাটাও খারাপনা, মানবিক ও দরকারি।
আসলে ভালবাসা কি? এর বেশিরভাগটাই এখনও রহস্য। কিন্তু এটাতো মূলত একটা জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুনা। কবিতা টবিতা, দর্শন ইত্যাদি ভালবাসার আউটকাম। আমরা যেটাকে প্রেমময় ভালবাসা বলি সেটার তিনটা পর্যায় আছে। কামনা, আকর্ষণ আর বন্ধন।
কামনার পর্যায়ে শুধু টেস্টস্টোরেন আর ইস্ট্রোজেন, সেরোটোনিন হরমোনের খেলা। যথেষ্ট টেস্টস্টোরেন ও ইস্ট্রোজেন খরচ করে আকর্ষণ পর্যায়ে যাওয়ার জন্য যুক্ত হয় ডোমাপিন। ডোপামিন হল দুনিয়ায় সকল ধরণের উত্তেজনা ও আসক্তি সৃষ্টির কারণ। এই দুই পর্যায়ে মানুষ কখনও বিয়ে বা বাচ্চার কথা ভাবতে পারেনা। ফলে যেসব ছেলেমেয়েরা প্রেম করেছে বলেই বিয়ে করতে হবে, বা শরীর বিনিময় করেছে তাই বিয়ে করতেই হবে বলে মনে করে, তারা হিপোক্রেট। আমাদের সাউথ এশিয়ান সমাজব্যবস্থার বড় ধরণের ভণ্ডামিটাও এটা। এখানে এই দুই স্তর পার হতে না হতেই যারা বিয়ে করে বা সেটল ম্যারেজ করে, তারা অ্যাটাচমেন্ট লেভেলে জোর করে ঢোকে। বয়োজ্যেষ্ঠরা (বিশেষত যারা একই সাফারিংস এর ভেতর দিয়ে যায়) এটার একটি আর্থসামাজিক সুবিধাজনক আউটকাম তৈরি করেছে, ফলে তারা মনে করে, এতে জীবন সহজ হবে, কিন্তু হয় এর উল্টোটা। আর্থ সামাজিক সুবিধাগুলো অ্যাভেইল করতে পারলেও আবেগীয় ও শারীরিকভাবে তারা অপূরনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা তারা কোনদিন বুঝতে পারেনা, কারণ যেহেতু তারা কখনও প্রাকৃতিকভাবে ভালবাসা জিনিসটা পূর্নাংগভাবে এক্সপেরিয়েন্স করেনি। সেটল ম্যারেজ বা ঐ দুই স্তর পার হতে না হতেই বিয়ে করার দম্পতির মধ্যে ভালবাসা তৈরি হবার হার খুবই কম। তাই সেটল ম্যারেজ ও পরকীয়া, ম্যারিটাল রেপ ও বিচ্ছেদ এর হার সমানুপাতিক কিংবা বেশি।
ইয়োরোপীয় আমেরিকানরা অন্তত ভালবাসার সাইন্সটা বোঝে বলে এসব ভণ্ডামি হিপোক্রেসি প্রশ্রয় দেয় না বা চর্চা করেনা। মানুষ দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের কথা চিন্তা করে একমাত্র যখন অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন হরমোন কাজ করে তাদের শরীরে, তখন। দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বা অ্যাটাচমেন্ট পর্যায়ে পরস্পর বন্ধু হয় এসব হরমোনের প্রভাবে, সেই বন্ধুত্বের মধ্যে থাকে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। আকর্ষণ ও কামনা কিন্তু তখনও অটুট, কিন্তু বন্ধুত্বের উপাদানগুলো তখন বেশি কার্যকর হয়। এইসব হরমোনের প্রভাবে তখন আর সে উত্তেজনা বোধ করেনা, বরং ভালবাসার মানুষকে দেখে স্বস্তি পায়। সেক্স ছাড়াই একে অন্যের সান্নিধ্যে থাকতে পারে দীর্ঘক্ষণ বা ডিসট্যান্ট রিলেশনশিপেও সমস্যা হয়না। এই পর্যায়ে কিছুকাল কাটাবার পর মানুষ বিয়ে এবং বাচ্চার কথা চিন্তা করে কিংবা উভয় মিলে কিছু একটা তৈরির চিন্তা করে- সেটা কোন শিল্প হতে পারে, বাড়ি হতে পারে, যেকোনো কিছু হতে পারে। মোটকথা They literally try to unify in every way and create something new.এবং এখানেই থেমে যায়না তারা, যা কিছু সৃষ্টি করে সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং পারষ্পারিক বিকাশও ঘটায়।
এখন কোন couple (যারা আসলেই ভালবাসা জিনিসটা এক্সপেরিয়েন্স করেছে) যদি বিয়ে করে, বাচ্চা বড় করে, তারাও কিন্তু অনেক সময় বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে দীর্ঘ কয়েক বছরের বৈবাহিক জীবনের পরও। তাহলে কি তারা Unsuccessful? আমি তা মনে করিনা। কারণ তারা ভালবাসার সবকিছুই এক্সপেরিয়েন্স করেছে, কিন্তু কোন একটা জায়গায় গিয়ে তাদের হয়তো বিকাশটা থেমে গেছে, তাই বিচ্ছেদটাকে তারা সমাধান মনে করেছে। এটাকে নেতিবাচকভাবে নেবার কোন কারণ নেই।
সমাজের কথা চিন্তা করে মৃত ভালবাসার লাশের বোঝা বয়ে চলা কোন কাজের কথা না। এতে নিজের বেঁচে থাকার গতি শ্লথ হয়, আনন্দ আর তৈরি হয় না। ভালবাসা হল একটা অভিজ্ঞতা। কারো জীবনে ভালবাসার যেকোনো পর্যায়ে বিচ্ছেদ হতে পারে, আবার যেকোনো দিক থেকে বা যেকারো কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত ভালবাসা পেয়ে যাবারও সম্ভাবনা আছে। ভালবাসার জন্য তাই জীবনভর “No regret” মোডে থাকাই ভাল।
তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ব্লগ, দি এনাটমি অফ লাভ ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া